জয়পুরহাট জেলার ইতিহাস, তথ্য ও দর্শনীয় স্থান সমূহ

জয়পুরহাট বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের একটি জেলা, রাজশাহী বিভাগের অংশ। এটি দক্ষিণে বগুড়া, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা, উত্তরে দিনাজপুর জেলা এবং পূর্ব ও পশ্চিমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সীমান্তবর্তী। জেলাটির সদর জয়পুরহাট শহর। বগুড়া জেলা থেকে পৃথক করে ১৯৮৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি জেলাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। জেলাটি পাঁচটি উপজেলায় বিভক্ত: জয়পুরহাট সদর, আক্কেলপুর, কালাই, ক্ষেতলাল, ও পাঁচবিবি। জেলার প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হল কৃষি ও পশুপালন। জেলায় উৎপাদিত প্রধান ফসল ধান, পাট, গম এবং শাকসবজি। জেলার প্রধান গবাদি পশু হল গবাদি পশু, ছাগল এবং হাঁস। জেলার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মুসলমান, সঙ্গে হিন্দু সংখ্যালঘু। জেলায় কথিত প্রধান ভাষাগুলি হল বাংলা এবং হিন্দি।

এই জেলায় অনেক ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক স্থান রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে প্রাচীন নগর পাহাড়পুরের ধ্বংসাবশেষ, যা একসময় পাল সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল। এছাড়াও এই জেলায় বেশ কিছু মসজিদ, মন্দির এবং অন্যান্য ধর্মীয় ভবন রয়েছে।

Joypurhat-District

জয়পুরহাট জেলার ইতিহাস

সময়ের সাথে পাল্টে গেছে জয়পুরহাট জেলার নাম। এলাকার আসল নাম ছিল বাঘাবাড়িহাট, যা পরবর্তীতে গোপেন্দ্রগঞ্জহাটে পরিবর্তন করা হয়। ১৯৮৪ সালে এর নাম পরিবর্তন করে জয়পুরহাট জেলা করা হয়। বাঘাবাড়ি বাজার নামক স্থানীয় বাজারের নাম থেকে বাঘাবাড়ীহাট নামটি এসেছে। গোপেন্দ্রগঞ্জ নামক স্থানীয় এক জমির মালিকের নাম থেকে গোপেন্দ্রগঞ্জহাট নামটি এসেছে।

জয়পুরহাট নামটি পাল সাম্রাজ্যের রাজা জয়পালের নাম থেকে এসেছে বলে ধারণা করা হয়। জয়পাল দশম শতাব্দীতে এই এলাকা শাসন করতেন বলে জানা যায়। জেলাটি বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত এবং এটি রাজশাহী বিভাগের একটি অংশ।

জয়পুরহাট জেলার থানা/উপজেলা সমূহ

জয়পুরহাট জেলাটিকে পাঁচটি উপজেলা বা থানায় ভাগ করা হয়েছে যেমন:

  1. আক্কেলপুর উপজেলা,
  2. কালাই উপজেলা,
  3. ক্ষেতলাল উপজেলা,
  4. পাঁচবিবি উপজেলা,
  5. জয়পুরহাট সদর উপজেলা।

নিম্নে প্রতিটি উপজেলার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেওয়া হল:

আক্কেলপুর উপজেলা

আক্কেলপুর উপজেলাটি জেলার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত। এর মোট আয়তন প্রায় ১৩৯.৪৭ বর্গ কিলোমিটার। উপজেলাটির জনসংখ্যা প্রায় ১২৮,৯৫২ জন। উপজেলা সদর আক্কেলপুর শহরে অবস্থিত।

কালাই উপজেলা

কালাই উপজেলাটি জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। এর মোট আয়তন প্রায় ১৬৬.৩০ বর্গ কিলোমিটার। উপজেলাটির জনসংখ্যা প্রায় ১২৯,৩২৯ জন। উপজেলা সদর কালাই শহরে অবস্থিত।

ক্ষেতলাল উপজেলা

ক্ষেতলাল উপজেলাটি জেলার দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত। এর মোট আয়তন ১৪২.৬০ বর্গ কিলোমিটার। উপজেলাটির জনসংখ্যা প্রায় ১১৫,৯১৮ জন। উপজেলা সদর ক্ষেতলাল শহরে অবস্থিত।

পাঁচবিবি উপজেলা

জেলার কেন্দ্রস্থলে পাঁচবিবি উপজেলা। এর মোট আয়তন প্রায় ২৭৮.৫৩ বর্গ কিলোমিটার। উপজেলাটির জনসংখ্যা প্রায় ২১৫,৮০৬ জন। উপজেলা সদর পাঁচবিবি শহরে অবস্থিত।

জয়পুরহাট সদর উপজেলা

জয়পুরহাট সদর উপজেলাটি জেলার উত্তর-পূর্বে অবস্থিত। এর মোট আয়তন ২৩৮.৫৪ বর্গ কিলোমিটার। উপজেলাটির জনসংখ্যা প্রায় ২৫৬,৬৯১ জন। উপজেলা সদর জয়পুরহাট শহরে অবস্থিত।

জয়পুরহাট জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ

জয়পুরহাট জেলাটিতে অনেক ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক/দর্শনীয় স্থানের আবাসস্থল, যার মধ্যে রয়েছে:

পঞ্চবিবি মন্দির

এই মন্দিরটি সেই পাঁচজন বিবিকে (নারী) উৎসর্গ করা হয়েছে যাদেরকে মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের হাতে হত্যা করা হয়েছিল বলে জানা যায়। মন্দিরটি জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলায় অবস্থিত।
কালাই রাজবাড়ি: এই প্রাসাদটি ১৮ শতকে কালাই নবাবদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। রাজবাড়িটি জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলায় অবস্থিত।

আক্কেলপুর দুর্গ

এই দুর্গটি ১৬ শতকে মুঘল সম্রাট আকবর তৈরি করেছিলেন। দুর্গটি জয়পুরহাট জেলার আক্কেলপুর উপজেলায় অবস্থিত।

জয়পুরহাট জাদুঘর

এই জাদুঘরে জয়পুরহাট জেলার ইতিহাস ও সংস্কৃতির নিদর্শন রয়েছে। জয়পুরহাট জেলার জয়পুরহাট সদর উপজেলায় জাদুঘরটি অবস্থিত।

জয়পুরহাট চিড়িয়াখানা

এই চিড়িয়াখানায় সিংহ, বাঘ, হাতি, বানর সহ বিভিন্ন প্রাণীর বাসস্থান। চিড়িয়াখানাটি জয়পুরহাট জেলার জয়পুরহাট সদর উপজেলায় অবস্থিত।

এই ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক স্থানগুলি ছাড়াও, জয়পুরহাটে অনেকগুলি প্রাকৃতিক আকর্ষণ রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:

জয়পুরহাট লেক

এই লেকটি সাঁতার কাটা, বোটিং এবং মাছ ধরার জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। লেকটি জয়পুরহাট জেলার জয়পুরহাট সদর উপজেলায় অবস্থিত।

ক্ষেতলাল পাহাড়

এই পাহাড়গুলো হাইকিং এবং ক্যাম্পিং করার জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। পাহাড়গুলো জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল উপজেলায় অবস্থিত।

পাঁচবিবি পাহাড়

পিকনিক এবং পাখি দেখার জন্য এই পাহাড়গুলি একটি জনপ্রিয় স্থান। জয়পুরহাট জেলার পাঁচবিবি উপজেলায় পাহাড়ের অবস্থান।

জয়পুরহাট একটি সুন্দর এবং ঐতিহাসিক জেলা যেখানে দর্শনার্থীদের জন্য অনেক কিছু রয়েছে। আপনি ইতিহাস, সংস্কৃতি বা প্রকৃতির প্রতি আগ্রহী হোন না কেন, জয়পুরহাটে আপনি উপভোগ করার মতো কিছু খুঁজে পাবেন।

জয়পুরহাট জেলা পার্ক/উদ্যান

জয়পুরহাট জেলা উদ্যান বাংলাদেশের জয়পুরহাটে অবস্থিত একটি পাবলিক পার্ক। এটি স্থানীয় এবং পর্যটকদের জন্য একইভাবে একটি জনপ্রিয় স্পট এবং এটি তার সবুজ, সুন্দর ফুল এবং নির্মল পরিবেশের জন্য পরিচিত। পার্কটি একটি খেলার মাঠ, একটি সুইমিং পুল এবং একটি চিড়িয়াখানা সহ বেশ কয়েকটি আকর্ষণের আবাসস্থল।

পার্কটি ১৯৬২ সালে জয়পুরহাটের তৎকালীন জেলা প্রশাসক এম এ মান্নান কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি মূলত "জয়পুরহাট টাউন পার্ক" নামকরণ করা হয়েছিল, কিন্তু ১৯৮৪ সালে "জয়পুরহাট জেলা পার্ক" নামকরণ করা হয়েছিল। পার্কটি ১০০ একরেরও বেশি এলাকা জুড়ে রয়েছে এবং এটি দুটি ভাগে বিভক্ত: 

  1. ওল্ড পার্ক,
  2. নিউ পার্ক।

ওল্ড পার্কে বট, আম এবং কাঁঠাল গাছ সহ বেশ কিছু পরিপক্ক গাছ রয়েছে। উদ্যানটি বেশ কয়েকটি ফুলের বিছানারও আবাসস্থল, যেগুলোতে গোলাপ, লিলি এবং গাঁদা সহ বিভিন্ন ধরনের ফুল লাগানো হয়। ওল্ড পার্কটি বেশ কয়েকটি বেঞ্চ এবং গেজেবোর আবাসস্থল, যা দর্শনার্থীদের বিশ্রাম এবং দৃশ্য উপভোগ করার জন্য একটি জায়গা প্রদান করে।

নিউ পার্কে একটি খেলার মাঠ, একটি সুইমিং পুল এবং একটি চিড়িয়াখানা সহ বেশ কয়েকটি আধুনিক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। খেলার মাঠটি বিভিন্ন দোল, স্লাইড এবং আরোহণের ফ্রেমে সজ্জিত এবং এটি শিশুদের জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। সুইমিং পুল জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত, এবং গরমের দিনে শীতল হওয়ার জন্য এটি একটি দুর্দান্ত জায়গা। চিড়িয়াখানাটি সিংহ, বাঘ, হাতি এবং বানর সহ বিভিন্ন প্রাণীর আবাসস্থল।

যে কারনে জয়পুরহাট জেলা বিখ্যাত

জয়পুরহাট অনেক কিছুর জন্য বিখ্যাত, যার মধ্যে কিছু রয়েছে:

  • কৃষি: জয়পুরহাট ধান, গম, আখ এবং অন্যান্য ফসলের একটি প্রধান উৎপাদক। এটি দেশের বৃহত্তম চিনিকল, জয়পুরহাট সুগার মিলস লিমিটেডের বাড়িও। জেলার অর্থনীতি প্রধানত ধান, আলু, গম, পেঁয়াজ, আম, কাঁঠাল এবং কলার মতো মৌসুমী ফসলের উপর ভিত্তি করে। এটি বিপুল পরিমাণ আখও উৎপাদন করে এবং এটি দেশের বৃহত্তম চিনিকল, জয়পুরহাট সুগার মিল'স লিমিটেডের ধারক। এ জেলায় রয়েছে প্রচুর শিল্প-কারখানা, রাইস মিল ও পোল্ট্রি ফার্ম। এটি অনেক কৃষি পণ্য রপ্তানি করে। হিলি স্থলবন্দরটি জয়পুরহাট জেলার খুব কাছে হওয়ায় এই জেলার অনেক মানুষ এই বন্দর দিয়ে আমদানি-রপ্তানি ব্যবসা করে এবং এই বন্দরের প্রায় সব যানবাহন এই জেলার উপর দিয়ে চলে। এই জেলা সব ধরনের ব্যবসার জন্য উপযুক্ত।
  • ইতিহাস: জয়পুরহাট ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট সোমপুর বিহার সহ অনেক ঐতিহাসিক স্থানের আবাসস্থল। সোমপুর বিহার হল বৌদ্ধ মঠ এবং মন্দিরের একটি গ্রুপ যা ৮ম এবং ৯ম শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল। এটি বাংলাদেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। জয়পুরহাটের অন্যান্য ঐতিহাসিক স্থানগুলির মধ্যে রয়েছে পাগলা দেওয়ান বোধভুমি, ১৭ শতকের একটি প্রাসাদ এবং বেলামলা গ্রাম, যেখানে দুটি ঐতিহাসিক মন্দির রয়েছে।
  • প্রাকৃতিক সৌন্দর্য: জয়পুরহাট বাংলাদেশের একটি সুন্দর অংশে অবস্থিত, যেখানে পাহাড়, বন ও নদী রয়েছে। জেলাটি মধুপুর জাতীয় উদ্যানের আবাসস্থল, একটি ১,১০০ বর্গ কিলোমিটার (৪২০ বর্গ মাইল) বন সংরক্ষিত। পার্কটি হাতি, বাঘ, হরিণ এবং বানর সহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম নদী যমুনা নদীরও আবাসস্থল জয়পুরহাট। নদীটি মাছ ধরা এবং বোটিং করার জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য।
  • মানুষ: জয়পুরহাট একটি বৈচিত্র্যময় এবং বন্ধুত্বপূর্ণ জনসংখ্যার আবাসস্থল। এই জেলায় সারা বাংলাদেশের মানুষের পাশাপাশি অন্যান্য দেশের লোকের বাস। জয়পুরহাটের মানুষ তাদের আতিথেয়তা এবং জীবন প্রেমের জন্য পরিচিত।

প্রাচীন নগরী পাহাড়পুরের ধ্বংসাবশেষ সহ এই জেলায় ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক স্থান রয়েছে। জেলাটিতে জয়পুরহাট জাতীয় উদ্যান সহ অনেকগুলি প্রাকৃতিক আকর্ষণ রয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন