খুলনা বিভাগ তথ্য, ইতিহাস ও দর্শনীয় স্থান সমূহ

খুলনা বিভাগ বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এবং এর দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর, উত্তরে রাজশাহী বিভাগ, পূর্বে ঢাকা বিভাগ এবং বরিশাল বিভাগ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য। বিভাগটির আয়তন প্রায় ২২,২৮৫ বর্গ কিলোমিটার এবং জনসংখ্যা প্রায় ১৭ মিলিয়নেরও বেশি। খুলনা বিভাগের রাজধানী হল খুলনা শহর যা বাংলাদেশের তৃতীয় বৃহত্তম শহর। বিভাগটি বাংলাদেশের একটি প্রধান শিল্প ও বাণিজ্যিক কেন্দ্র। বিভাগটি পাট প্রক্রিয়াকরণ, জাহাজ নির্মাণ ও চিনি পরিশোধন সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের আবাসস্থল। এছাড়াও খুলনা একটি প্রধান পরিবহন কেন্দ্র, যেখানে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, রেলপথ এবং জলপথ শহরের মধ্য দিয়ে যায়। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন খুলনা বিভাগের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত। সুন্দরবন ইউনেস্কোর একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান এবং এটি বাঘ, হাতি ও ডলফিন সহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল।

Khulna-pision

খুলনা বিভাগের ইতিহাস

খুলনা বিভাগের ইতিহাসে প্রাচীন বঙ্গ ও সমতট রাজ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। এই অঞ্চলটি সেন রাজবংশ ইলিয়াস শাহী রাজবংশ ও হোসেন শাহী রাজবংশ দ্বারা শাসিত হয়। ১৫ শতকে অঞ্চলটি মুঘল সাম্রাজ্য দ্বারা জয় করা হয়েছিল। মুঘলরা এই অঞ্চলে দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে শাসন করেছে এবং এই সময়ে খুলনা একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।

১৮ শতকে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয় এবং অবশেষে খুলনা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বারা জয় করা হয়। ব্রিটিশরা এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এই অঞ্চলে শাসন করেছিল এবং এই সময়ে খুলনা পাট এবং অন্যান্য কৃষি পণ্য রপ্তানির একটি প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ভারতীয় সাম্রাজ্য দুটি স্বাধীন দেশে বিভক্ত হয়: ভারত ও পাকিস্তান। খুলনা বিভাগ ছিল নতুন দেশ পাকিস্তানের অংশ। ১৯৬০ সালে খুলনা বিভাগ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

স্বাধীনতার পর থেকে খুলনা বিভাগ দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি লাভ করেছে। এই অঞ্চলটি এখন শিল্প, কৃষি এবং বাণিজ্যের জন্য একটি প্রধান কেন্দ্র। খুলনাতে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় এবং খুলনা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আজ খুলনা বিভাগ একটি প্রাণবন্ত ও সমৃদ্ধ অঞ্চল। বিভাগটি একটি বৈচিত্র্যময় জনসংখ্যার আবাসস্থল এবং এর অর্থনীতি দ্রুত বর্ধনশীল। শিল্প, কৃষি এবং বাণিজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্র এবং এটি বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আবাসস্থল। এই বিভাগের একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যত রয়েছে এবং এটি বাংলাদেশের উন্নয়নে ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে প্রস্তুত।

খুলনা বিভাগের জেলা সমূহ

বিভাগটি ১০ টি জেলার সমন্বয়ে গঠিত, যা হলো:

  1. বাগেরহাট জেলা,
  2. চুয়াডাঙ্গা জেলা,
  3. যশোর জেলা,
  4. খুলনা জেলা,
  5. মেহেরপুর জেলা,
  6. কুষ্টিয়া জেলা,
  7. নড়াইল জেলা,
  8. সাতক্ষীরা জেলা,
  9. শেরপুর জেলা,
  10. ঝিনাইদহ জেলা।

প্রতিটি জেলা আবার উপজেলায় বিভক্ত যেগুলো পরে ইউনিয়নে বিভক্ত। খুলনা বিভাগের জেলাগুলোতে বিভিন্ন ধরনের মানুষ ও সংস্কৃতির আবাসস্থল। জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মুসলিম, তবে উল্লেখযোগ্য হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রিস্টান সম্প্রদায়ও রয়েছে। এই বিভাগটি সাঁওতাল, মুন্ডা এবং ওরাওঁ সহ বেশ কয়েকটি জাতিগত সংখ্যালঘুদের আবাসস্থল।

খুলনা বিভাগের দর্শনীয় স্থান সমূহ

খুলনা বিভাগ অনেক দর্শনীয় ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক আকর্ষণের আবাসস্থল, যার মধ্যে রয়েছে:

  • সুন্দরবন: পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন।
  • ষাট গম্বুজ মসজিদ: ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট।
  • শিলাইদহ কুঠিবাড়ি: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাবেক বাসভবন।
  • ফকির লালন শাহের মাজার: সুফি সাধক ফকির লালন শাহের মাজার।
  • দ্য ১৯৭১: জেনোসাইড-টর্চার আর্কাইভ অ্যান্ড মিউজিয়াম: ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ গণহত্যার শিকারদের জন্য নিবেদিত একটি যাদুঘর।
  • মাইকেল মধুসূদন দত্ত মেমোরিয়াল হাউস: বাঙালি কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তকে নিবেদিত একটি জাদুঘর।
  • বাগেরহাট জাদুঘর: বাগেরহাটের ইতিহাসের জন্য নিবেদিত একটি জাদুঘর।
  • জেস গার্ডেন পার্ক: যশোরের একটি পার্ক।
  • চাঁচড়া শিব মন্দির: খুলনার একটি হিন্দু মন্দির।
  • শেখ আবু নাসের স্টেডিয়াম: খুলনার একটি স্টেডিয়াম।

এসব আকর্ষণ ছাড়াও খুলনা বিভাগ অনেক প্রাকৃতিক আকর্ষণের আবাসস্থল, যার মধ্যে রয়েছে:

  • রূপসা নদী: খুলনা বিভাগের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদী।
  • মহানন্দা নদী: খুলনা বিভাগের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত একটি নদী।
  • চিলমারী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য: খুলনা বিভাগের একটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য।
  • সুন্দরবন ন্যাশনাল পার্ক: খুলনা বিভাগের একটি জাতীয় উদ্যান।

খুলনা বিভাগ একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য এবং সমস্ত আগ্রহের দর্শনার্থীদের জন্য বিভিন্ন ধরনের আকর্ষণের প্রস্তাব দেয়।

খুলনা বিভাগের মধ্যে পার্ক সমূহ

খুলনা বিভাগে অনেক পার্ক ও উদ্যান রয়েছে যার মধ্যে কয়েকটি তুলে ধরা হলো:

খুলনা সিটি পার্ক

খুলনা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই পার্কটি স্থানীয় ও পর্যটকদের কাছে একইভাবে একটি জনপ্রিয় স্থান। পার্কটিতে খেলার মাঠ, সুইমিং পুল, রেস্তোরাঁ এবং মসজিদ সহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা রয়েছে।

শহীদ হাদিস পার্ক

রূপসা নদীর তীরে অবস্থিত এই পার্কটি পিকনিক এবং নৌকা ভ্রমণের জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। পার্কটিতে শহীদ হাদিস স্মৃতিসৌধ এবং শহীদ মিনার সহ অনেক ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে।

চন্দ্র মহল ইকো পার্ক

বাগেরহাট জেলায় অবস্থিত এই পার্কটি পাখি দেখার এবং প্রকৃতিতে হাঁটার জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। উদ্যানটি বেঙ্গল টাইগার, দাগযুক্ত হরিণ এবং কালো হরিণ হরিণ সহ বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীর আবাসস্থল।

জেস গার্ডেন পার্ক

এই পার্কটি যশোর জেলায় অবস্থিত এবং এটি পরিবার এবং শিশুদের জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। পার্কটিতে খেলার মাঠ, একটি সুইমিং পুল এবং একটি মিনি চিড়িয়াখানা সহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।

মোজাফফর গার্ডেন পার্ক

এই পার্কটি সাতক্ষীরা জেলায় অবস্থিত এবং এটি পিকনিক এবং নৌকা ভ্রমণের জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। পার্কটিতে মোজাফফর গার্ডেন মেমোরিয়াল মনুমেন্ট এবং মোজাফফর মিনার সহ বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে।

তামান্না পার্ক

ঝিনাইদহ জেলায় অবস্থিত এই পার্কটি পরিবার ও শিশুদের জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। পার্কটিতে খেলার মাঠ, একটি সুইমিং পুল এবং একটি মিনি চিড়িয়াখানা সহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।

ওয়ান্ডারল্যান্ড অ্যামিউজমেন্ট পার্ক: এই পার্কটি খুলনা শহরে অবস্থিত এবং এটি পরিবার এবং শিশুদের জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। পার্কটিতে রোলার কোস্টার, ওয়াটার রাইড এবং একটি 3D থিয়েটার সহ বিভিন্ন রাইড এবং আকর্ষণ রয়েছে।

এস.এস ওয়ার্ল্ড পার্ক

এই পার্কটি খুলনা শহরে অবস্থিত এবং এটি পরিবার এবং শিশুদের জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। পার্কটিতে রোলার কোস্টার, ওয়াটার রাইড এবং একটি 4D থিয়েটার সহ বিভিন্ন রাইড এবং আকর্ষণ রয়েছে।

খুলনা বিভাগের অনেকগুলো পার্ক ও উদ্যানের মধ্যে এগুলো মাত্র কয়েকটি। আপনি যদি বাংলাদেশের এই অংশে ভ্রমণের পরিকল্পনা করে থাকেন, তাহলে এই সুন্দর ও শান্ত স্থানগুলির এক বা একাধিক পরিদর্শন করতে ভুলবেন না।

যে কারণে খুলনা বিভাগ বিখ্যাত

খুলনা বিভাগ বিভিন্ন কারণে বিখ্যাত যার মধ্যে রয়েছে:

  • অবস্থান: খুলনা বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে রূপসা ও ভৈরব নদীর তীরে অবস্থিত। এটি এটিকে একটি কৌশলগত অবস্থান দেয়, কারণ এটি একটি প্রধান পরিবহন হাব এবং বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনের একটি প্রবেশদ্বার।
  • শিল্প: খুলনা একটি প্রধান শিল্প কেন্দ্র, যেখানে পাট, টেক্সটাইল এবং চিংড়ি সহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য উৎপাদন করা হয়।
  • পর্যটন: খুলনা সুন্দরবন, মসজিদের শহর বাগেরহাট এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম সহ বেশ কিছু পর্যটন আকর্ষণের আবাসস্থল।
  • সংস্কৃতি: খুলনা একটি বৈচিত্র্যময় জনসংখ্যার আবাসস্থল, যেখানে বিভিন্ন জাতিগত ও ধর্মীয় পটভূমির লোক রয়েছে। এই বৈচিত্র্য শহরের সংস্কৃতিতে প্রতিফলিত হয়, যা বাঙালি, হিন্দু, মুসলমান এবং অন্যান্য প্রভাবের মিশ্রন।
খুলনা বিখ্যাত হওয়ার কয়েকটি নির্দিষ্ট কারণ এখানে দেওয়া হল:
  • সুন্দরবন: সুন্দরবন ইউনেস্কোর একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান এবং বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল। এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য এবং স্থানীয় জনগণের আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসও বটে।
  • বাগেরহাটের মসজিদ শহর: বাগেরহাটের মসজিদ শহরটি ইউনেস্কোর একটি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান এবং এখানে ১৫ শতকে নির্মিত বেশ কয়েকটি মসজিদ রয়েছে। মসজিদগুলি বাংলা ও ইসলামিক স্থাপত্যের সংমিশ্রণ এবং এগুলোকে বাংলাদেশের ইসলামিক স্থাপত্যশৈলীর সেরা উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
  • চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল: চট্টগ্রাম পার্বত্য অঞ্চল বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্ব অংশের একটি পাহাড়ি অঞ্চল। এটি চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা সহ বেশ কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর আবাসস্থল। অঞ্চলটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য এবং কাঠ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস।

সামগ্রিকভাবে খুলনা বিভাগ একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধ একটি উন্নয়নশীল অঞ্চল এবং এই বিভাগে অর্থনৈতিক ও পর্যটনের অনেক সুযোগ রয়েছে যা অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ব্যবহার করা যেতে পারে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন