ময়মনসিংহ বিভাগ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সমূহ

ময়মনসিংহ বিভাগ দেশের উত্তর-মধ্য অংশে অবস্থিত এবং এর আয়তন প্রায় ১০,৪৮৫ বর্গ কিলোমিটার (৪,০৪৮ বর্গ মাইল)। ২০২২ সালের আদমশুমারি অনুসারে বিভাগটির জনসংখ্যা ১২,২২৫,৪৯৮ জন। এর সদর দপ্তর ময়মনসিংহ শহরে অবস্থিত। ময়মনসিংহ বিভাগ একটি প্রধান কৃষি অঞ্চল এবং ধান, পাট ও গম উৎপাদনের জন্য পরিচিত। এই বিভাগটি চিনি, চা এবং কাগজ উৎপাদন সহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের আবাসস্থল। ময়মনসিংহ বিভাগ একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতির সাথে একটি প্রাণবন্ত এবং বৈচিত্র্যময় অঞ্চল।

Mymensingh-pision

ময়মনসিংহ বিভাগের ইতিহাস

ময়মনসিংহ বিভাগের ইতিহাস দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ, এই অঞ্চলটি প্রথম প্রস্তর যুগে মানুষের দ্বারা বসতি স্থাপন করেছিল। এই অঞ্চলটি পরবর্তীতে মৌর্য সাম্রাজ্য, গুপ্ত সাম্রাজ্য, পাল সাম্রাজ্য এবং সেন সাম্রাজ্য সহ বিভিন্ন সাম্রাজ্য ও রাজ্য দ্বারা শাসিত হয়েছিল। ১৩ শতকে এই অঞ্চলটি বাংলার মুসলিম সালতানাত দ্বারা জয় করা হয়েছিল এবং পরবর্তী কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত এটি মুসলিম শাসনের অধীনে ছিল।

১৮ শতকে এই অঞ্চলটি ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দ্বারা জয় করা হয়েছিল। ব্রিটিশরা এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে এই অঞ্চলে শাসন করেছিল এবং এই সময়ে ময়মনসিংহ ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ব্রিটিশরা এই অঞ্চলে বেশ কয়েকটি স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করেছিল, যা শিক্ষা ও শিক্ষার প্রচারে সাহায্য করেছিল।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে চলে যায় এবং এই অঞ্চলটি দুটি নতুন দেশে বিভক্ত হয়: ভারত ও পাকিস্তান। ময়মনসিংহ পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয় যা পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ হয়।

স্বাধীনতার পর থেকে ময়মনসিংহের বিকাশ অব্যাহত রয়েছে। অঞ্চলটি এখন কৃষি, শিল্প এবং শিক্ষার একটি কেন্দ্র। এছাড়াও ময়মনসিংহে ময়মনসিংহ জাদুঘর, ময়মনসিংহ রাজবাড়ী এবং ময়মনসিংহ বোটানিক্যাল গার্ডেন সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক স্থান রয়েছে।

ময়মনসিংহ বিভাগের জেলা সমূহ

ময়মনসিংহ বিভাগের চারটি জেলা হল:

  1. ময়মনসিংহ জেলা,
  2. জামালপুর জেলা,
  3. শেরপুর জেলা,
  4. নেত্রকোনা জেলা।

ময়মনসিংহ জেলা

ময়মনসিংহ জেলা এই বিভাগের বৃহত্তম ও জনবহুল জেলা। এটি বিভাগের মধ্যভাগে অবস্থিত এবং উত্তরে জামালপুর জেলা, পূর্বে শেরপুর জেলা, দক্ষিণে নেত্রকোনা জেলা এবং পশ্চিমে টাঙ্গাইল জেলা দ্বারা সীমাবদ্ধ। জেলাটির আবাসস্থল ময়মনসিংহ শহরে, যা বিভাগীয় সদর দপ্তর।

জামালপুর জেলা

জামালপুর জেলাটি বিভাগের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত। এটি দক্ষিণে ময়মনসিংহ জেলা, পূর্বে কিশোরগঞ্জ জেলা এবং পশ্চিমে নরসিংদী জেলা দ্বারা বেষ্টিত। জেলার সদর দপ্তর জামালপুর শহরে অবস্থিত।

শেরপুর জেলা

বিভাগের পূর্বাংশে শেরপুর জেলা অবস্থিত। এটি পশ্চিমে ময়মনসিংহ জেলা, দক্ষিণে নেত্রকোনা জেলা এবং পূর্বে হবিগঞ্জ জেলা দ্বারা বেষ্টিত। জেলার সদর দপ্তর শেরপুর শহরে অবস্থিত।

নেত্রকোনা জেলা

নেত্রকোনা জেলাটি বিভাগের দক্ষিণ অংশে অবস্থিত। এটি উত্তরে ময়মনসিংহ জেলা, পশ্চিমে শেরপুর জেলা এবং দক্ষিণে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা দ্বারা বেষ্টিত। জেলার সদর দপ্তর নেত্রকোনা শহরে অবস্থিত।

ময়মনসিংহ বিভাগের জেলাগুলো উর্বর জমি, বনাঞ্চল এবং নদী সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক সম্পদের আবাসস্থল। মহাস্থানগড়ের প্রাচীন নগরীর ধ্বংসাবশেষ সহ এই বিভাগটিতে বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক স্থান রয়েছে।

ময়মনসিংহ বিভাগের দর্শনীয় স্থান সমূহ

ময়মনসিংহ বিভাগের সবচেয়ে জনপ্রিয় কিছু পর্যটন আকর্ষণের মধ্যে রয়েছে:

ময়মনসিংহ জাদুঘর

ময়মনসিংহ জাদুঘর বাংলাদেশের প্রাচীনতম জাদুঘরগুলির মধ্যে একটি। এটি ১৮৭৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং জীবাশ্ম, মৃৎশিল্প এবং অস্ত্র সহ এই অঞ্চলের শিল্পকর্মের একটি সংগ্রহ রয়েছে।

মুক্তাগাছা রাজবাড়ী

মুক্তাগাছা রাজবাড়ী হল ১৯ শতকের একটি প্রাসাদ কমপ্লেক্স যা একসময় মুক্তাগাছা জমিদারদের আবাসস্থল ছিল। কমপ্লেক্সটি এখন একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য এবং এর সুন্দর বাগান ও স্থাপত্যের জন্য পরিচিত।

আলেকজান্দ্রা ক্যাসেল

আলেকজান্দ্রা ক্যাসেল হল ১৯ শতকের একটি দুর্গ যা ব্রিটিশদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। দুর্গটি এখন একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য এবং গথিক স্থাপত্য এবং সুন্দর বাগানের জন্য পরিচিত।

শশী লজ

শশী লজ হল ১৯ শতকের একটি প্রাসাদ যা একসময় ময়মনসিংহের মহারাজার বাড়ি ছিল। লজটি এখন একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য এবং এটি তার সুন্দর বাগান এবং স্থাপত্যের জন্য পরিচিত।

হাসান মঞ্জিল

হাসান মঞ্জিল হল ১৯ শতকের একটি প্রাসাদ যা একসময় হাসান পরিবারের আবাসস্থল ছিল। প্রাসাদটি এখন একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য এবং এটি তার সুন্দর বাগান এবং স্থাপত্যের জন্য পরিচিত।

গজনি অবকাশ কেন্দ্র

গজনি অবকাশ কেন্দ্র হল শেরপুর জেলায় অবস্থিত একটি বড় বিনোদন পার্ক। পার্কটি স্থানীয় এবং পর্যটকদের জন্য একইভাবে একটি জনপ্রিয় স্থান এবং এটি রাইড, গেম এবং খাবারের জন্য পরিচিত।

চায়না মাটির পাহাড়

চীন মাটির পাহাড় নেত্রকোনা জেলায় অবস্থিত একটি বড় পাহাড়। পাহাড়টি তার সাদা কাদামাটির জন্য পরিচিত, যেটির ঔষধি গুণ রয়েছে বলে কথিত আছে।

সোমেশ্বরী নদী

সোমেশ্বরী নদী নেত্রকোনা জেলার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত একটি বৃহৎ নদী। নদীটি মাছ ধরা, সাঁতার কাটা এবং নৌকা চালানোর জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান।

ময়মনসিংহ বিভাগের অনেকগুলো পর্যটন আকর্ষণের মধ্যে এগুলো কয়েকটি মাত্র।

ময়মনসিংহ বিভাগের মধ্যে পার্ক সমূহ

বাংলাদেশের ময়মনসিংহ বিভাগে অনেকগুলো পার্ক আছে। কিছু জনপ্রিয় পার্কের মধ্যে রয়েছে:

বেপিন পার্ক

ময়মনসিংহ শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এই পার্কটি পরিবার ও শিশুদের জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। এটিতে একটি খেলার মাঠ, একটি হ্রদ এবং বিভিন্ন ধরনের গাছ ও ফুল রয়েছে৷

মধুটিলা ইকো পার্ক

মধুটিলা ইকো পার্ক শেরপুর জেলায় অবস্থিত একটি বড় ইকো পার্ক। পার্কটি স্থানীয় এবং পর্যটকদের জন্য একইভাবে একটি জনপ্রিয় স্থান এবং এটি তার সুন্দর বন, হ্রদ এবং জলপ্রপাতের জন্য পরিচিত।

প্রিয়কুঞ্জ পার্ক

এই পার্কটি ময়মনসিংহের চুরখাইতে অবস্থিত এবং এটি পিকনিক এবং আউটডোর কার্যকলাপের জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। এটিতে একটি বড় লন, একটি খেলার মাঠ এবং বিভিন্ন ধরণের গাছ এবং ফুল রয়েছে৷

ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান

ভাওয়াল জঙ্গলে অবস্থিত এই পার্কটি পাখি দেখার এবং প্রকৃতিতে হাঁটার জন্য একটি জনপ্রিয় স্পট। এটিতে বিভিন্ন ধরণের গাছ এবং গাছপালা, সেইসাথে হরিণ, বানর এবং বাঘ সহ বেশ কয়েকটি প্রাণী রয়েছে।

ময়মনসিংহ বিভাগের অনেকগুলো পার্কের মধ্যে এগুলো মাত্র কয়েকটি। এর সুন্দর দৃশ্য এবং সবুজ স্থানের প্রাচুর্যের সাথে, ময়মনসিংহ আউটডোর উপভোগ করার জন্য একটি দুর্দান্ত জায়গা।

যে কারণে ময়মনসিংহ বিভাগ বিখ্যাত

এখানে ময়মনসিংহ বিভাগ বিখ্যাত হওয়ার কয়েকটি কারণ রয়েছে:

প্রাকৃতিক সৌন্দর্য

ময়মনসিংহ বিভাগ ব্রহ্মপুত্র নদ, মধুপুর বন এবং ময়মনসিংহ হাওর সহ অনেকগুলি প্রাকৃতিক আকর্ষণের আবাসস্থল। ব্রহ্মপুত্র নদ বাংলাদেশের দীর্ঘতম নদীগুলির মধ্যে একটি এবং মাছ ধরা এবং নৌকা চালানোর জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। মধুপুর বন হল একটি বৃহৎ বন যেখানে হাতি, বাঘ এবং হরিণ সহ বিভিন্ন ধরনের বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। ময়মনসিংহ হাওর একটি বিশাল জলাভূমি এলাকা যেখানে বিভিন্ন ধরনের পাখি ও মাছের আবাসস্থল।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান

ময়মনসিংহ বিভাগে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ সহ বেশ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আবাসস্থল। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলির মধ্যে একটি এবং কৃষি ও সংশ্লিষ্ট বিজ্ঞানে বিভিন্ন ধরনের প্রোগ্রাম অফার করে। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় হল একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যা ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টি মানবিক, সামাজিক বিজ্ঞান এবং প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে বিভিন্ন ধরনের প্রোগ্রাম অফার করে। ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ একটি মেডিকেল কলেজ যা ১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কলেজটি পাঁচ বছরের এমবিবিএস প্রোগ্রাম অফার করে।

ঐতিহাসিক গুরুত্ব

ময়মনসিংহ বিভাগে ময়মনসিংহ দুর্গ এবং ময়মনসিংহ জাদুঘর সহ অনেক ঐতিহাসিক স্থান রয়েছে। ময়মনসিংহ দুর্গটি ১৭ শতকে মুঘলদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। দুর্গটি এখন একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য এবং বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক ভবনের আবাসস্থল। ময়মনসিংহ জাদুঘরটি ১৯১৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। জাদুঘরে জীবাশ্ম, মুদ্রা এবং অস্ত্র সহ এই অঞ্চলের নিদর্শনগুলির একটি সংগ্রহ রয়েছে।

সামগ্রিকভাবে, ময়মনসিংহ বিভাগ একটি সুন্দর এবং ঐতিহাসিক স্থান যেখানে দর্শনার্থীদের জন্য অনেক সুবিধা রয়েছে। এই বিভাগটি অনেকগুলি প্রাকৃতিক আকর্ষণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং ঐতিহাসিক স্থানগুলির আবাসস্থল।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন