বরগুনা জেলার তথ্য, ইতিহাস ও দর্শনীয় স্থান সমূহ

বরগুনা জেলা হলো বাংলাদেশের বরিশাল বিভাগের একটি জেলা। এটি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত। বরগুনা মহকুমা ১৯৬৯ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ২৮ ফেব্রুয়ারী ১৯৮৪ সালে জেলায় উন্নীত হয়। এটি উত্তরে ঝালকাঠি, বরিশাল, পিরোজপুর এবং পটুয়াখালী জেলা দ্বারা সীমাবদ্ধ। পূর্বে, এটি পটুয়াখালী জেলার সীমানা। দক্ষিণে, বরগুনা পটুয়াখালী জেলা এবং বঙ্গোপসাগর দ্বারা সীমাবদ্ধ। পশ্চিম দিকে পিরোজপুর ও বাগেরহাট জেলার সীমানা। এর গুরুত্বপূর্ণ নদীর মধ্যে রয়েছে পায়রা নদী, বিষখালী নদী, খাকদন নদী, বলেশ্বর নদী এবং হরিণঘাটা নদী।

জেলার জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মুসলিম, তারপরে হিন্দু ও বৌদ্ধ। জেলার অর্থনীতি কৃষি, মাছ ধরা এবং বনায়নের উপর নির্ভরশীল। জেলায় উৎপাদিত প্রধান ফসল ধান, পাট, ধান, গম, ভুট্টা, শাকসবজি এবং ফলমূল। এছাড়াও জেলাটি বেশ কয়েকটি মৎস্য ও বনজ শিল্পের আবাসস্থল।

Barguna-District

বরগুনা জেলার ইতিহাস

বরগুনা জেলার নামকরণের ইতিহাস একটি জটিল ও বহুমুখী। একটি তত্ত্ব হল বরগুনা নামটি এসেছে বাংলা শব্দ "বড়গুন" থেকে যার অর্থ "উচ্চ জোয়ার"। এই তত্ত্বটি এই সত্য দ্বারা সমর্থিত যে জেলাটি খাকদন নদীর তীরে অবস্থিত, যা জোয়ার-ভাটার জন্য পরিচিত। অতীতে, উত্তরাঞ্চলের কাঠ ব্যবসায়ীদের নদীতে তাদের নৌকা টেনে তোলার জন্য প্রায়ই জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করতে হতো। ধারণা করা হয়, এই অপেক্ষার কারণেই বরগুনা নামের উৎপত্তি হয়েছে।

আরেকটি তত্ত্ব হল এই এলাকায় বসতি স্থাপনকারী বিশিষ্ট মগ সম্প্রদায়ের নাম থেকে বরগুনা নামটি এসেছে। মগরা হল মধ্য এশিয়ায় উদ্ভূত একদল লোক, এবং তাদের বাংলাদেশে বসবাসের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এটা বিশ্বাস করা হয় যে মগরা ছিল সর্বপ্রথম এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে যেটি বর্তমানে বরগুনা জেলা, এবং তাদের নামই এই জেলার নামের উত্থান ঘটায়।

অবশেষে এটাও সম্ভব যে বরগুনা নামটি কেবল এলাকার আসল নামের অপভ্রংশ। এলাকাটি মূলত "বরগা" নামে পরিচিত ছিল এবং এটা সম্ভব যে সময়ের সাথে সাথে অন্যান্য ভাষা বা সংস্কৃতির প্রভাবের কারণে নামটি পরিবর্তন করে বরগুনা রাখা হয়েছিল।

নামের প্রকৃত উৎপত্তি যাই হোক না কেন, বরগুনা একটি সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সমৃদ্ধ একটি সুন্দর ও ঐতিহাসিক জেলা। জেলাটি একটি বৈচিত্র্যময় জনসংখ্যার আবাসস্থল এবং এটি পর্যটকদের জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্যস্থল।

বরগুনা জেলার উপজেলা/থানা সমূহ

বরগুনা জেলার মোট ছয়টি থানা/উপজেলা হল:

  1. বরগুনা সদর উপজেলা,
  2. বেতাগী উপজেলা,
  3. বামনা উপজেলা,
  4. পাথরঘাটা উপজেলা,
  5. তালতলী উপজেলা,
  6. আমতলী উপজেলা।

এখানে ৬টি উপজেলার সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া হলো:

  • বরগুনা সদর উপজেলা: এটি বরগুনা জেলার প্রশাসনিক সদর। এটি পায়রা নদীর তীরে অবস্থিত। উপজেলায় ১১টি ইউনিয়ন ও ১১২টি গ্রাম রয়েছে।
  • বেতাগী উপজেলা: বিষখালী নদীর তীরে অবস্থিত বেতাগী উপজেলা। উপজেলায় ১০টি ইউনিয়ন ও ৯৫টি গ্রাম রয়েছে।
  • বামনা উপজেলা: বলেশ্বর নদীর তীরে বামনা উপজেলা অবস্থিত। উপজেলায় ১০টি ইউনিয়ন ও ৯৮টি গ্রাম রয়েছে।
  • পাথরঘাটা উপজেলা: হরিণঘাটা নদীর তীরে পাথরঘাটা উপজেলা অবস্থিত। উপজেলায় ১০টি ইউনিয়ন ও ৯৭টি গ্রাম রয়েছে।
  • তালতলী উপজেলা: পায়রা নদীর তীরে অবস্থিত তালতলী উপজেলা। উপজেলায় ১০টি ইউনিয়ন ও ৯৬টি গ্রাম রয়েছে।
  • আমতলী উপজেলা: এটি পায়রা নদীর তীরে অবস্থিত। উপজেলায় ১০টি ইউনিয়ন ও ৯৯টি গ্রাম রয়েছে।

বরগুনা জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ

এখানে বাংলাদেশের বরগুনা জেলার জনপ্রিয় কিছু দর্শনীয় স্থান/পর্যটন আকর্ষণ সম্পর্কে দেওয়া হলো:

বিবিচিনি শাহী মসজিদ

বিবিচিনি শাহী মসজিদ হল ১৭ শতকের একটি মসজিদ যেটি জেলার প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে সুসংরক্ষিত মসজিদগুলির মধ্যে একটি। এটি বরগুনা শহর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে বিবিচিনি গ্রামে অবস্থিত।

লালদিয়া বন

লালদিয়া বন বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থিত একটি ম্যানগ্রোভ বন। বনটি ডলফিন, কুমির এবং পাখি সহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল।

বরগুনা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার

এটি বরগুনা শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি উদ্যান। এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা শহীদদের স্মরণে উৎসর্গ করা হয়েছে। পার্কটিতে একটি স্মৃতিস্তম্ভ, একটি ফুলের বাগান এবং একটি খেলার মাঠ আছে।

সোনাকাটা সমুদ্র সৈকত

সোনাকাটা সমুদ্র সৈকত বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থিত একটি সুন্দর সমুদ্র সৈকত। সমুদ্র সৈকত সাঁতার কাটা, সূর্যস্নান এবং মাছ ধরার জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান।

এই আকর্ষণগুলি ছাড়াও, বরগুনায় আরও অনেক ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক স্থান রয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে:

  • কাজী কালুর সমাধি: এটি হল ষোড়শ শতাব্দীর একজন সাধুর সমাধি, যার অলৌকিক ক্ষমতা রয়েছে বলে কথিত আছে। সমাধিটি বরগুনা শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে তেপুরা গ্রামে অবস্থিত।
  • চাওরা পাটাকাটায় ক্লে ফোর্ট: এটি ১৭ শতকের একটি দুর্গ যা মুঘলদের দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। দুর্গটি বরগুনা শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে চাওড়া পাটাকাটা গ্রামে অবস্থিত।
  • নাথপট্টি হ্রদ: এটি বরগুনা শহরে অবস্থিত একটি বড় হ্রদ। হ্রদটি মাছ ধরা এবং নৌকা চালানোর জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান।

বরগুনা জেলার পাবলিক পার্ক সমূহ

বাংলাদেশের বরগুনা জেলায় অনেক পাবলিক পার্ক আছে। কিছু জনপ্রিয় পার্কের মধ্যে রয়েছে:

বরগুনা টাউন পার্ক

এটি বরগুনা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত একটি বৃহৎ পার্ক। এটি পরিবার এবং বন্ধুদের জন্য বিশ্রাম এবং বাইরে উপভোগ করার জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। পার্কটিতে একটি খেলার মাঠ, একটি সুইমিং পুল এবং বিভিন্ন ধরণের গাছ এবং ফুল রয়েছে।

বরগুনা সমুদ্র সৈকত পার্ক

এটি বরগুনা জেলার উপকূলে অবস্থিত একটি পার্ক। এটি সাঁতার, সূর্যস্নান এবং মাছ ধরার জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। পার্কটিতে একটি খেলার মাঠ, একটি রেস্তোরাঁ এবং বিভিন্ন ধরণের গাছ এবং ফুল রয়েছে।

বরগুনা ট্যুরিস্ট পার্ক

এটি বরগুনা জেলার উপকূলে অবস্থিত একটি পার্ক। এটি পিকনিক, ক্যাম্পিং এবং পাখি দেখার জন্য একটি জনপ্রিয় স্পট। পার্কটিতে একটি খেলার মাঠ, একটি রেস্তোরাঁ এবং বিভিন্ন ধরনের গাছ ও ফুল রয়েছে।

হরিণঘাটা ফরেস্ট ইকো পার্ক

এটি হরিণ, বানর এবং পাখি সহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল একটি বৃহৎ বন সংরক্ষিত স্থান। পার্কটিতে বেশ কয়েকটি হাইকিং ট্রেইল এবং পিকনিক স্পট রয়েছে।

ফাতরার বন (ফরেস্ট) এবং ইকো পার্ক

এটি হল একটি বন সংরক্ষিত যেখানে হরিণ, বানর এবং পাখি সহ বিভিন্ন ধরণের বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। পার্কটিতে বেশ কয়েকটি হাইকিং ট্রেইল এবং পিকনিক স্পট রয়েছে।

যে কারনে বরগুনা জেলা বিখ্যাত

  • প্রাকৃতিক সৌন্দর্য: বরগুনা বঙ্গোপসাগরের উপকূলে অবস্থিত এবং এটি সমুদ্র সৈকত, বন এবং নদী সহ বেশ কয়েকটি সুন্দর প্রাকৃতিক আকর্ষণের আবাসস্থল।
  • সোনাকাটা সমুদ্র সৈকত: বরগুনা জেলার সোনাকাটা উপজেলায় এই সমুদ্র সৈকতটি অবস্থিত। এটি সাঁতার কাটা, সূর্যস্নান এবং পিকনিক করার জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য।
  • ফাতরার বন: বরগুনা জেলার ফাতরার উপজেলায় এই বনটি অবস্থিত। এটি বিভিন্ন ধরণের গাছ এবং প্রাণীর আবাসস্থল এবং এটি পাখি দেখার এবং হাইকিংয়ের জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য।
  • লালদিয়া বন: বরগুনা জেলার লালদিয়া উপজেলায় এই বনটি অবস্থিত। এটি বিভিন্ন ধরণের গাছ এবং প্রাণীর আবাসস্থল এবং এটি পাখি দেখার এবং হাইকিংয়ের জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য।
  • মৎস্যশিল্প: বরগুনা বাংলাদেশের একটি প্রধান মৎস্যকেন্দ্র। জেলাটিতে বেশ কয়েকটি মাছ ধরার গ্রাম রয়েছে এবং এটি মাছ ও চিংড়ির একটি প্রধান উৎপাদক।
  • ঐতিহাসিক স্থান: বরগুনা অনেক ঐতিহাসিক স্থানের বাড়ি, যার মধ্যে রয়েছে:
  • বিবিচিনি শাহী মসজিদ: এই মসজিদটি বরগুনা জেলার বেতাগী উপজেলায় অবস্থিত। এটি ১৭ শতকে নির্মিত হয়েছিল, এবং এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন স্থান।
  • গর্জনবুনিয়া সিডর স্মৃতিসৌধ: এই স্মৃতিসৌধটি বরগুনা সদর উপজেলার গর্জনবুনিয়া গ্রামে অবস্থিত। ২০০৮ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডরে নিহতদের স্মরণে এটি নির্মিত হয়েছিল।
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মাছ ধরার শিল্প এবং ঐতিহাসিক স্থান ছাড়াও, বরগুনা তার সংস্কৃতি এবং এর জনগণের জন্যও পরিচিত। জেলাটি বেশ কয়েকটি উৎসব ও উদযাপনের আবাসস্থল এবং বরগুনার মানুষ তাদের আতিথেয়তার জন্য পরিচিত।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন