সুনামগঞ্জ জেলার তথ্য, ইতিহাস ও দর্শনীয় স্থান সমূহ

সুনামগঞ্জ জেলা হল সিলেট বিভাগের অন্তর্গত বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বে অবস্থিত একটি জেলা। এটি উত্তরে মেঘালয় (ভারতীয় রাজ্য) এর খাসিয়া ও জৈন্তিয়া পাহাড়ি এলাকা, দক্ষিণে হবিগঞ্জ জেলা, পূর্বে সিলেট জেলা এবং পশ্চিমে নেত্রকোনা জেলা দ্বারা সীমাবদ্ধ। এটি সিলেট বিভাগের অধীনে। এ জেলার একটি শক্তিশালী ইতিহাস রয়েছে এবং ভারতের প্রতিবেশী রাজ্যের মণিপুরী, খাসিয়া, গারো এবং হাজং জাতিগোষ্ঠীর সাথে বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতির ঐতিহ্য রয়েছে। সুরমা, কালনী, কুশিয়ারা, বাওলাই, ধনু, শমেশ্বরী, জালালপুর প্রভৃতি নদী এবং ধান, তৈলবীজ, কমলা, আম, শাকসবজি, মাছ প্রভৃতি কৃষিজাত দ্রব্য সহ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য এই জেলাটি পরিচিত।

জেলাটি প্রাচীন সোনারগাঁও শহরের ধ্বংসাবশেষ, হযরত শাহ জালাল (রঃ) এর মাজার, হযরত শাহ পরান (রঃ) এর মাজার এবং সুনামগঞ্জ জাদুঘর সহ বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থানের আবাসস্থল। হাকালুকি হাওর, মধুপুর জাতীয় উদ্যান এবং নীলাচল পাহাড়ের মতো আকর্ষণ সহ সুনামগঞ্জ একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য।

Sunamganj-District

সুনামগঞ্জ নামকরণ ও জেলার ইতিহাস

সুনামগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস দীর্ঘ ও জটিল। জেলাটি মূলত লাউর রাজ্যের অংশ ছিল, যেটি একটি হিন্দু রাজ্য ছিল যেটি ৭ম থেকে ১৩ শতক পর্যন্ত এই অঞ্চলে বিদ্যমান ছিল। ১৩০৩ সালে মুসলমানদের সিলেট বিজয়ের পর, লাউড় রাজ্য বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং সুনামগঞ্জ সিলেট সালতানাতের অংশ হয়। "সুনামগঞ্জ" নামটি এর প্রতিষ্ঠাতা, সিপাহী সুনামুদ্দিনের নাম থেকে এসেছে, যিনি ১৪ শতকে সুরমা নদীর তীরে একটি বাজার প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

ষোড়শ শতাব্দীতে সুনামগঞ্জ মুঘল সাম্রাজ্যের হাতে জয়লাভ করে। মুঘলরা এই অঞ্চলে ২০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে শাসন করেছিল, সেই সময়ে সুনামগঞ্জ ব্যবসা-বাণিজ্যের একটি প্রধান কেন্দ্র হয়ে ওঠে। ১৮ শতকে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয় এবং সুনামগঞ্জ ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দ্বারা জয় করা হয়। ব্রিটিশরা ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে সুনামগঞ্জ শাসন করে, সেই সময়ে জেলাটি উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন দেখেছিল।

১৯৪৭ সালে যখন ভারত ও পাকিস্তান ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে, সুনামগঞ্জ পূর্ব পাকিস্তানের অংশ হয়। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে ওঠে। সুনামগঞ্জ তখন থেকেই বাংলাদেশের অংশ।

সুনামগঞ্জ জেলার নামকরণের ইতিহাস এ অঞ্চলের দীর্ঘ ও জটিল ইতিহাসের প্রতিফলন। জেলাটি বহু শতাব্দী ধরে বিভিন্ন সাম্রাজ্য এবং রাজ্য দ্বারা শাসিত হয়েছে এবং প্রত্যেকটি জেলার সংস্কৃতি এবং পরিচয়ের উপর নিজস্ব ছাপ রেখে গেছে। আজ সুনামগঞ্জ একটি সমৃদ্ধ ইতিহাস ও সংস্কৃতির সাথে একটি প্রাণবন্ত ও বৈচিত্র্যময় জেলা।

সুনামগঞ্জ জেলার উপজেলা/থানা সমূহ

সুনামগঞ্জ জেলার ১১ টি উপজেলা/থানার নামগুলো হলো:

  1. সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা,
  2. দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা,
  3. বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা,
  4. ছাতক উপজেলা,
  5. জগন্নাথপুর উপজেলা,
  6. দোয়ারাবাজার উপজেলা,
  7. তাহিরপুর উপজেলা,
  8. ধর্মপাশা উপজেলা,
  9. জামালগঞ্জ উপজেলা,
  10. শাল্লা উপজেলা,
  11. দিরাই উপজেলা।

সুনামগঞ্জ জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ

এখানে বাংলাদেশের সুনামগঞ্জ জেলার জনপ্রিয় কিছু পর্যটন স্থান রয়েছে:

টাঙ্গুয়ার হাওর

এই বিস্তীর্ণ জলাভূমি মাছ, পাখি এবং কুমির সহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। এটি পাখি দেখার এবং বোটিং করার একটি জনপ্রিয় গন্তব্য।

সুরমা সেতু

এই আইকনিক ব্রিজটি সুরমা নদীর উপর বিস্তৃত এবং সুনামগঞ্জকে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে সংযুক্ত করেছে। এটি ফটোগ্রাফি এবং দর্শনীয় স্থানগুলির জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান।

বারিক টিলা

এই পাহাড়ের চূড়াটি পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলের অত্যাশ্চর্য দৃশ্য দেখায়। এটি পিকনিক এবং হাইকিংয়ের জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান।

জাদুকাটা নদী

এই নদীটি তার র্যাপিড এবং জলপ্রপাতের জন্য পরিচিত। এটি হোয়াইট ওয়াটার রাফটিং এবং কায়াকিং এর জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য।

শ্রীমঙ্গল

এই জনপদ চা বাগানের জন্য পরিচিত। এটি চা প্রেমী এবং প্রকৃতি উত্সাহীদের জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য।

নীলাদ্রি লেক

সুনামগঞ্জ শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই লেকটি। এটি সাঁতার, বোটিং এবং মাছ ধরার জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান।

শ্রীমঙ্গল বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য

এই অভয়ারণ্য হরিণ, হাতি এবং বাঘ সহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল। বন্যপ্রাণী উত্সাহীদের কাছে এটি একটি জনপ্রিয় গন্তব্য।

লাতু সাহেবের মাজার

এই সমাধিটি লাতু সাহেবকে উৎসর্গ করা হয়েছে, একজন মুসলিম সাধক যার অলৌকিক ক্ষমতা আছে বলে কথিত আছে। এটি তীর্থযাত্রী এবং পর্যটকদের জন্য একইভাবে একটি জনপ্রিয় গন্তব্য।

ধামরাই

এই গ্রামটি ঐতিহ্যবাহী নৌকা তৈরির শিল্পের জন্য পরিচিত। এটি পর্যটকদের জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য যারা ঐতিহ্যবাহী নৌকা তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে শিখতে চান।

কমলাপুর

ঐতিহ্যবাহী মৃৎশিল্পের জন্য পরিচিত এই গ্রামটি। এটি পর্যটকদের জন্য একটি জনপ্রিয় গন্তব্য যারা ঐতিহ্যগত মৃৎশিল্প প্রক্রিয়া সম্পর্কে শিখতে চান।

সুনামগঞ্জ জেলার পাবলিক পার্ক সমূহ

এখানে সুনামগঞ্জ জেলার কিছু পাবলিক পার্ক সম্পর্কে দেওয়া হয়েছে:

সুনামগঞ্জ সিটি পার্ক

এটি সুনামগঞ্জের সবচেয়ে জনপ্রিয় পার্ক। এটি শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এবং বিশ্রাম নেওয়ার এবং বাইরে উপভোগ করার জন্য এটি একটি দুর্দান্ত জায়গা। পার্কটিতে খেলার মাঠ, সুইমিং পুল এবং জগিং ট্র্যাক সহ বিভিন্ন সুবিধা রয়েছে।

সুনামগঞ্জ সরকারী পার্ক

এই পার্কটি সুনামগঞ্জ সিটি পার্কের কাছে অবস্থিত। এটি একটি ছোট পার্ক, তবে এটি এখনও বিশ্রাম নেওয়ার এবং বাইরে উপভোগ করার একটি দুর্দান্ত জায়গা। পার্কটিতে বিভিন্ন ধরণের গাছ এবং ফুল রয়েছে এবং এটি পিকনিকের জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান।

সুনামগঞ্জ ট্যুরিস্ট পার্ক

এই পার্কটি সুরমা নদীর তীরে অবস্থিত। এটি নদীর দৃশ্য এবং তাজা বাতাস উপভোগ করার জন্য একটি দুর্দান্ত জায়গা। পার্কটিতে খেলার মাঠ, সুইমিং পুল এবং রেস্তোরাঁ সহ বিভিন্ন সুবিধা রয়েছে।

সুনামগঞ্জ ওয়ার সিমেট্রি

এই কবরস্থানটি সুনামগঞ্জের উপকণ্ঠে অবস্থিত। এটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মারা যাওয়া ১,০০০ টিরও বেশি ব্রিটিশ এবং কমনওয়েলথ সৈন্যদের শেষ বিশ্রামের স্থান। যুদ্ধে যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের স্মরণ করার জন্য কবরস্থান একটি শান্তিপূর্ণ স্থান।

সুনামগঞ্জ চিড়িয়াখানা

এই চিড়িয়াখানাটি সুনামগঞ্জের উপকণ্ঠে অবস্থিত। এটি বাঘ, সিংহ, হাতি এবং বানর সহ বিভিন্ন ধরণের প্রাণীর বাসস্থান। চিড়িয়াখানা প্রাণীদের সম্পর্কে জানার এবং তাদের কাছে থেকে দেখার জন্য একটি দুর্দান্ত জায়গা।

যে কারনে সুনামগঞ্জ জেলা বিখ্যাত

সুনামগঞ্জ জেলা তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, সমৃদ্ধ সংস্কৃতি এবং বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর জন্য বিখ্যাত। এটি উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশের সিলেট বিভাগে অবস্থিত। জেলাটির উত্তরে মেঘালয় (ভারতীয় রাজ্য) এর খাসিয়া ও জৈন্তিয়া পাহাড়ি এলাকা, দক্ষিণে হবিগঞ্জ জেলা, পূর্বে সিলেট জেলা এবং পশ্চিমে নেত্রকোনা জেলা অবস্থিত।

সুনামগঞ্জে মিঠা পানির মাছের একটি বড় উৎস। বাংলাদেশের অন্য যেকোনো জেলার চেয়ে এই জেলায় বেশি হাওর রয়েছে। হাওর হল বড়, অগভীর জলাভূমি যেখানে বিভিন্ন ধরনের মাছ এবং অন্যান্য জলজ প্রাণীর বাসস্থান।

জেলাটি মণিপুরী, খাসিয়া, গারো এবং হাজং সহ বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আবাসস্থল। এই গোষ্ঠীগুলির নিজস্ব স্বতন্ত্র সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্য রয়েছে, যা জেলার শিল্প, সংগীত এবং নৃত্যে প্রতিফলিত হয়। জেলাটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র। টাঙ্গুয়ার হাওর, হাসন রাজা জাদুঘর এবং পাগলা মসজিদ সহ বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক নিদর্শন এই জেলায় অবস্থিত। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের জন্যও সুনামগঞ্জ একটি চমৎকার স্থান। এই জেলাটি অনেকগুলি পাহাড়, নদী এবং জলাভূমির আবাসস্থল, যা অত্যাশ্চর্য দৃশ্যাবলী এবং বহিরঙ্গন কার্যকলাপের সুযোগ দেয়।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন