মুন্সিগঞ্জ জেলার তথ্য, ইতিহাস, দর্শনীয় স্থান সমূহ

মুন্সিগঞ্জ বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের একটি জেলা, ঢাকা বিভাগে অবস্থিত। জেলাটি একটি ঐতিহাসিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ জেলা এবং একসময় বিক্রমপুরের প্রাচীন রাজ্যের কেন্দ্র ছিল। এই জেলায় বিক্রমপুর দুর্গ, কান্তজিউ মন্দির এবং হযরত শাহ জালাল দরগাহ সহ বহু ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থানের আবাসস্থল। মুন্সীগঞ্জের অর্থনীতি কৃষি, মাছ ধরা এবং উৎপাদন নির্ভর। জেলাটি ধান, সবজি ও মাছের প্রধান উৎপাদক। তৈরি পোশাক শিল্পের আধিপত্য রয়েছে এবং জেলায় ছোট ও মাঝারি আকারের বেশ কয়েকটি কারখানা রয়েছে।

মুন্সীগঞ্জ একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য এবং এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ঐতিহাসিক স্থান এবং ধর্মীয় উৎসবের জন্য পরিচিত। এই জেলাটি অনেকগুলি নদী, খাল এবং হ্রদের আবাসস্থল এবং এটি নৌকা বিহার, মাছ ধরা এবং সাঁতারের জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। মুন্সীগঞ্জে অনেক ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থানও রয়েছে যা সারাদেশের দর্শনার্থীদের আকর্ষণ করে।

Munshiganj-District

মুন্সিগঞ্জ নামকরণ ও জেলার ইতিহাস

যুগে যুগে মুন্সীগঞ্জ জেলার নাম পরিবর্তন হয়েছে বহুবার। জেলাটি মূলত বিক্রমপুর নামে পরিচিত ছিল, যা ১০ থেকে ১৩ শতক পর্যন্ত চন্দ্র, বর্মণ ও সেন রাজবংশের রাজধানী ছিল। সেনদের উৎখাত করার পর, বিক্রমপুর ইলিয়াস শাহী, খলজি এবং তুঘলক সালতানাত সহ মুসলিম রাজবংশের উত্তরাধিকার দ্বারা শাসিত হয়েছিল। ষোড়শ শতকে বিক্রমপুর মুঘল সাম্রাজ্যের দ্বারা জয় করা হয়েছিল।

মুঘলরা হায়দার আলী মুন্সি নামে একজন মুসলিম জমিদারের নামানুসারে বিক্রমপুরের নাম পরিবর্তন করে মুন্সিগঞ্জ রাখে। মুন্সিগঞ্জ অষ্টাদশ শতকের গোড়ার দিকে মুঘল শাসনের অধীনে ছিল, যখন এটি বাংলার নবাবদের দ্বারা জয় করা হয়েছিল। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধ বাংলায় ব্রিটিশ শাসনের সূচনা করে। মুন্সীগঞ্জ তখন ঢাকা জেলার অংশ হিসেবে শাসিত হয়।

১৯৮৬ সালে মুন্সীগঞ্জ ঢাকা জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একটি পৃথক জেলায় পরিণত হয়। জেলাটি বর্তমানে বাংলাদেশের ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত। বিক্রমপুর থেকে মুন্সীগঞ্জ নাম পরিবর্তন ষোড়শ শতকে মুঘল সাম্রাজ্য এই অঞ্চল জয় করার পরে ঘটেছে বলে মনে করা হয়। মুঘলরা হায়দার আলী মুন্সি নামে একজন মুসলিম জমিদার (জমিদার) এর নামানুসারে জেলার নাম পরিবর্তন করে।

মুন্সিগঞ্জ জেলার উপজেলা/থানা সমূহ

মুন্সীগঞ্জ জেলায় ৬টি থানা/উপজেলা রয়েছে, যা হল:

  1. মুন্সীগঞ্জ সদর উপজেলা,
  2. শ্রীনগর উপজেলা,
  3. লৌহজং উপজেলা,
  4. সিরাজদিখান উপজেলা,
  5. গজারিয়া উপজেলা,
  6. টঙ্গীবাড়ী উপজেলা।

জেলাটি বাংলাদেশের ঢাকা বিভাগে অবস্থিত এবং উত্তরে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলা, দক্ষিণে মাদারীপুর ও শরীয়তপুর জেলা, পূর্বে কুমিল্লা ও চাঁদপুর জেলা এবং পশ্চিমে ঢাকা ও ফরিদপুর জেলা দ্বারা সীমাবদ্ধ।

মুন্সিগঞ্জ জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ

এখানে মুন্সিগঞ্জ জেলার কিছু পর্যটন/দর্শনীয় স্থান রয়েছে:

ইদ্রাকপুর দুর্গ

এই দুর্গটি ১৬৬০ সালে বাংলার সুবাহদার দ্বিতীয় মীর জুমলা তৈরি করেছিলেন। এটি মুন্সীগঞ্জ শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত এবং এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র।

মাওয়া ঘাট

মেঘনা নদীর তীরে অবস্থিত এই ঘাটটি নৌকা ভ্রমণ এবং নদী ভ্রমণের জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। এটি সিলেটে হযরত শাহ জালাল (রহ.)-এর পবিত্র মাজারে ফেরি চলাচলের সূচনাস্থলও।

সোনারং জোড়া মন্দির

এই মন্দির কমপ্লেক্সটি মুন্সীগঞ্জ জেলার সোনারং গ্রামে অবস্থিত। এটি ৭ম শতাব্দীতে দেববংশ দ্বারা নির্মিত বলে মনে করা হয়।

চর-পদ্মা মন্দির

পদ্মা নদীর একটি দ্বীপে এই মন্দিরটি অবস্থিত। এটি একাদশ শতকে সেন রাজবংশ দ্বারা নির্মিত বলে মনে করা হয়।

অতীশ দীপঙ্কর স্মৃতি মন্দির

এই মন্দিরটি বৌদ্ধ সাধক অতীশ দীপঙ্করকে উত্সর্গীকৃত, যিনি দশম শতাব্দীতে মুন্সীগঞ্জ জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে মনে করা হয়।

শ্যামসিদ্ধির মঠ

এই মঠটি মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলায় অবস্থিত। এটি দ্বাদশ শতাব্দীতে বৌদ্ধ সাধক শ্যামা সিদ্ধি দ্বারা নির্মিত হয়েছিল বলে মনে করা হয়।

গাজীপুর চিড়িয়াখানা

এই চিড়িয়াখানাটি মুন্সীগঞ্জ জেলার সংলগ্ন গাজীপুর জেলায় অবস্থিত। এটি হাতি, বাঘ, সিংহ এবং বানর সহ বিভিন্ন ধরণের প্রাণীর বাসস্থান।

পদ্মা সেতু

এই সেতুটি বাংলাদেশের দীর্ঘতম সেতু এবং মুন্সীগঞ্জ জেলার সাথে শরীয়তপুর জেলার সংযোগ স্থাপন করেছে। এটি একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য এবং পদ্মা নদীর অত্যাশ্চর্য দৃশ্য দেখায়।

মুন্সিগঞ্জ জেলার পাবলিক পার্ক সমূহ

এখানে মুন্সীগঞ্জ জেলার কয়েকটি পাবলিক পার্ক সম্পর্কে দেওয়া হলো:

মুন্সীগঞ্জ পৌরশহর শিশু পার্ক

এটি মুন্সীগঞ্জ শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত একটি বড় পার্ক। এটি একটি খেলার মাঠ, একটি হ্রদ এবং বিভিন্ন ধরনের গাছ ও ফুল সহ পরিবার এবং শিশুদের জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান।

ডিসি পার্ক

এটি মুন্সীগঞ্জের আরেকটি জনপ্রিয় পার্ক। এটি নদীর কাছাকাছি অবস্থিত, এবং পার্শ্ববর্তী গ্রামাঞ্চলের অত্যাশ্চর্য দৃশ্য দেখায়। পার্কটিতে খেলার মাঠ, জগিং ট্র্যাক এবং একটি রেস্তোরাঁ সহ বিভিন্ন সুবিধা রয়েছে।

জিলা শহীদ মিনার

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের স্মরণে এটি নিবেদিত একটি স্মৃতি উদ্যান। পার্কটি পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত, এবং স্থানীয় এবং পর্যটক উভয়ের জন্যই এটি একটি জনপ্রিয় স্থান।

নীলক্ষেত পার্ক

পার্কটি মুন্সীগঞ্জের নীলক্ষেত এলাকায় অবস্থিত একটি ছোট পার্ক। এটি মানুষের কাছে বিশ্রাম নেওয়ার এবং বাইরে উপভোগ করার জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। পার্কটিতে একটি খেলার মাঠ, একটি জগিং ট্র্যাক এবং বিভিন্ন ধরণের গাছ এবং ফুল রয়েছে।

যে কারনে মুন্সিগঞ্জ জেলা বিখ্যাত

মুন্সীগঞ্জ জেলা তার সমৃদ্ধ ইতিহাস, সংস্কৃতি ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত এছাড়াও এখানে কিছু বিষয় তুলে ধরা হলো:

  • এর ইতিহাস: মুন্সীগঞ্জ এক সময় প্রাচীন রাজ্য বিক্রমপুরের রাজধানী ছিল। বিক্রমপুরের ধ্বংসাবশেষ আজও দেখা যায়, এবং এই জেলায় কান্তজিউ এবং বড়দির মন্দির এবং লালবাগ দুর্গের ধ্বংসাবশেষ সহ বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে।
  • সংস্কৃতি: মুন্সীগঞ্জ বিভিন্ন জাতিগত ও ধর্মীয় পটভূমির মানুষের বৈচিত্র্যময় জনসংখ্যার আবাসস্থল। জেলাটি তার অনন্য সংস্কৃতির জন্য পরিচিত, যা বাঙালি, হিন্দু ও মুসলিম প্রভাবের মিশ্রন।
  • প্রাকৃতিক সৌন্দর্য: মুন্সীগঞ্জ পদ্মা নদীর তীরে অবস্থিত, এবং জেলাটি সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন, ইছামতি নদী, এবং কংশবতী নদী সহ অনেকগুলি প্রাকৃতিক আকর্ষণের আবাসস্থল।

এখানে মুন্সীগঞ্জ জেলার কিছু জনপ্রিয় পর্যটন আকর্ষণ তুলে ধরা হলো যার কারনেও মুন্সীগঞ্জ বিখ্যাত:

  • কান্তজিউ মন্দির: এই মন্দিরটি মুন্সীগঞ্জের প্রাচীনতম এবং গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরগুলির মধ্যে একটি। এটি ১২ শতকে নির্মিত হয়েছিল, এবং এটি হিন্দু দেবতা বিষ্ণুকে উৎসর্গ করা হয়েছে।
  • বড়দি মন্দির: এই মন্দিরটি মুন্সীগঞ্জের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু মন্দির। এটি ১৬ শতকে নির্মিত হয়েছিল, এবং এটি হিন্দু দেবী দুর্গাকে উৎসর্গ করা হয়েছে।
  • লালবাগ কেল্লা: এই কেল্লার ধ্বংসাবশেষ আজও দেখা যায়। এটি ১৭ শতকে নির্মিত হয়েছিল, এবং এটি একসময় বাংলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ ছিল।
  • সুন্দরবন ম্যানগ্রোভ বন: এটি বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, এবং বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্তে অবস্থিত। এটি বাঘ, কুমির এবং ডলফিন সহ বিভিন্ন ধরণের বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল।
  • ইছামতি নদী: এই নদীটি নৌকা বাইচ ও মাছ ধরার জন্য একটি জনপ্রিয় স্থান। এটি বেশ কয়েকটি দ্বীপের আবাসস্থল, যা পিকনিক এবং ক্যাম্পিং এর জন্য জনপ্রিয়।
  • কংসাবতী নদী: এই নদীটি নৌকা বিহার এবং মাছ ধরার জন্য আরেকটি জনপ্রিয় স্থান। এটি বেশ কয়েকটি মন্দির এবং মসজিদের আবাসস্থল, যা দেখার জন্য জনপ্রিয়।

মুন্সিগঞ্জ একটি জনপ্রিয় পর্যটন গন্তব্য, এবং এর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, ঐতিহাসিক স্থান এবং সাংস্কৃতিক আকর্ষণের জন্য পরিচিত। এই জেলাটি অনেকগুলি নদী, হ্রদ এবং বনের আবাসস্থল। মুন্সীগঞ্জে অনেক ঐতিহাসিক মসজিদ, মন্দির এবং উপাসনালয় রয়েছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন