শেরপুর জেলার তথ্য, ইতিহাস, দর্শনীয় স্থান সমূহ

শেরপুর জেলা বাংলাদেশের ময়মনসিংহ বিভাগের একটি জেলা। এটি ১৯৮৪ সালের আগে জামালপুর জেলার একটি মহকুমা ছিল যখন এটি একটি জেলায় উন্নীত হয়েছিল। শেরপুর জেলার উত্তরে ভারত, পূর্বে ময়মনসিংহ জেলা, দক্ষিণে এবং পশ্চিমে জামালপুর জেলা। জেলার প্রধান নদীগুলো হল ব্রহ্মপুত্র, কংশো ও ভোগাই। মালিঝি, সোমেশ্বরী, নিতাই, মহর্ষি এই জেলার কয়েকটি ছোট নদী। সিরামিক মাটি এই জেলার প্রধান প্রাকৃতিক সম্পদ।

শেরপুর জেলা শেরপুর দুর্গ, শেরপুর রাজবাড়ী, মধুটিলা ইকো পার্ক এবং গাজনি পর্যটন স্পট সহ অনেক ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক স্থানের আবাসস্থল। জেলাটি সিরামিক, পাট এবং সিল্ক উৎপাদনের জন্যও পরিচিত। এই জেলার জনসংখ্যার সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ মুসলমান, সঙ্গে হিন্দু সংখ্যালঘু। শেরপুর জেলায় কথিত প্রধান ভাষা হল বাংলা ও গারো। জেলাটি একটি উন্নয়নশীল জেলা যেখানে দর্শনার্থীদের জন্য অনেক কিছু রয়েছে। জেলাটি অনেকগুলি প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের স্পট, ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক স্থান এবং একটি প্রাণবন্ত সংস্কৃতির আবাসস্থল।

Sherpur-District

শেরপুর নামকরণ ও জেলার ইতিহাস

শেরপুর নামের অর্থ "শের আলী গাজীর নগরী"। শের আলী গাজী ছিলেন একজন সাহসী ও শক্তিশালী যোদ্ধা যিনি মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন। তিনি একজন জনপ্রিয় নেতা ছিলেন এবং তার জনগণ তাকে খুব শ্রদ্ধা করত। তার মৃত্যুর পর তার স্মরণে এলাকার মানুষ একে শেরপুর নামে ডাকতে থাকে।

নবাবী আমলে গাজী বংশের শেষ জমিদার শের আলী গাজী স্বাধীনভাবে এ এলাকা দখল করে রাজত্ব করেন। এরপর থেকে শাসক শের আলী গাজীর নামানুসারে এই এলাকার নাম "দশ কাহোনিয়া বাজু" থেকে পরিবর্তন করে শেরপুর করা হয়। ১৯৮৪ সালে শেরপুরকে বাংলাদেশের একটি জেলা ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে শেরপুর একটি সমৃদ্ধ জেলা এটি একটি কৃষি ও শিল্প কেন্দ্র।

শেরপুর জেলার উপজেলা/থানা সমূহ

বাংলাদেশের শেরপুর জেলায় ৬টি উপজেলা/থানা রয়েছে। যা হলো:
  1. শেরপুর সদর উপজেলা,
  2. নালিতাবাড়ী উপজেলা,
  3. শ্রীবর্দী উপজেলা,
  4. ঝিনাইগাতী উপজেলা,
  5. নকলা উপজেলা।
উপজেলাগুলো আবার ইউনিয়ন ও মৌজায় বিভক্ত। ইউনিয়নগুলি হল উপজেলাগুলির প্রশাসনিক ইউনিট ও মৌজাগুলি হল সবচেয়ে ছোট প্রশাসনিক ইউনিট।

শেরপুর জেলার দর্শনীয় স্থান সমূহ

বাংলাদেশের শেরপুর জেলার কিছু পর্যটন/দর্শনীয় স্থান গুলোর মধ্যে রয়েছে:

মধুটিলা ইকো পার্ক

এটি নালিতাবাড়ী উপজেলায় অবস্থিত একটি জনপ্রিয় পিকনিক স্পট। এটি বিভিন্ন গাছ, ফুল এবং প্রাণীর আবাসস্থল। দর্শনার্থীরা পার্কে নৌকা বিহার, হাইকিং এবং ক্যাম্পিং উপভোগ করতে পারেন।

গাজনী ইকো পার্ক

এই পার্কটি শেরপুর জেলার গারো পাহাড়ে অবস্থিত। এটি একটি পর্বতারোহণের জন্য যেতে বা দৃশ্যাবলী উপভোগ করার জন্য একটি দুর্দান্ত জায়গা। এছাড়াও এলাকায় বেশ কয়েকটি জলপ্রপাত এবং গুহা রয়েছে।

নয়ানী জমিদার বাড়ি

এটি শেরপুর সদর উপজেলায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক অট্টালিকা। এটি ঊনবিংশ শতকে নয়ানী পরিবার দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। প্রাসাদটি এখন একটি যাদুঘর যেখানে নয়ানী পরিবারের নিদর্শনগুলির একটি সংগ্রহ প্রদর্শন করা হয়৷

বড়দুয়ারী মসজিদ

শ্রীবরদী উপজেলায় এই মসজিদটি অবস্থিত। এটি সপ্তাদশ শতকের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। মসজিদটি মুঘল স্থাপত্যের একটি চমৎকার নিদর্শন।

পৌনে তিন আনি জমিদার বাড়ি

এটি নবীনগর উপজেলায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক প্রাসাদ। এটি ঊনবিংশ শতকে পাউনি টিন আনি পরিবার দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। প্রাসাদটি এখন একটি যাদুঘর যা পউনি টিন আনি পরিবারের নিদর্শনগুলির একটি সংগ্রহ প্রদর্শন করে৷

হযরত শাহ কামালের সমাধি

এটি ষোড়শ শতকে বসবাসকারী একজন সুফি সাধকের সমাধি। সমাধিটি শেরপুর সদর উপজেলায় অবস্থিত।

মাইসাহেবা মসজিদ

এই মসজিদটি শেরপুর সদর উপজেলায় অবস্থিত। এটি অষ্টাদশ শতকের মধ্যে নির্মিত হয়েছিল। মসজিদটি মুঘল স্থাপত্যের একটি চমৎকার নিদর্শন।

নালিতাবাড়ী রাবার ড্যাম

এই বাঁধটি নালিতাবাড়ী উপজেলায় অবস্থিত। মাছ ধরা এবং বোটিং এর জন্য এটি একটি জনপ্রিয় স্থান।

শেরপুর জেলার অনেকগুলো পর্যটন/দর্শনযোগ্য স্থানের মধ্যে এগুলি কয়েকটি মাত্র। এই সুন্দর জেলায় দেখার মতো আরও অনেক কিছুই রয়েছে।

শেরপুর জেলার পাবলিক পার্ক সমূহ

শেরপুর জেলায় অনেকগুলো পাবলিক পার্ক আছে। এখানে জনপ্রিয় কয়েকটি পার্ক সম্পর্কে তুলে ধরা হলো:

ডিসি পার্ক শেরপুর

শেরপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এই পার্কটি স্থানীয় এবং পর্যটকদের কাছে একইভাবে একটি জনপ্রিয় স্থান। এটি একটি খেলার মাঠ, একটি হাঁটার ট্র্যাক, একটি বোটিং লেক এবং একটি রেস্তোরাঁ সহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা রয়েছে৷

গোল্ডেন ভেলি পার্ক

এই পার্কটি শেরপুর শহরের উপকণ্ঠে অবস্থিত এবং শহরের জীবনের কোলাহল এড়াতে এটি একটি দুর্দান্ত জায়গা। এটিতে বিভিন্ন ধরণের গাছ এবং গাছপালা, সেইসাথে একটি ছোট হ্রদ রয়েছে।

ক্যাকটাস পার্ক

এই উদ্যানটি শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলায় অবস্থিত এবং এখানে বিভিন্ন ধরণের ক্যাকটি এবং অন্যান্য রসালো খাবার রয়েছে। এই আকর্ষণীয় গাছপালা সম্পর্কে জানতে ও গ্রামাঞ্চলের শান্তি ও নিরিবিলি উপভোগ করার জন্য এটি একটি দুর্দান্ত জায়গা।

যে কারনে শেরপুর জেলা বিখ্যাত

শেরপুর জেলা অনেক কিছুর জন্য বিখ্যাত, যার মধ্যে রয়েছে:
  • এর সমৃদ্ধ ইতিহাস এবং সংস্কৃতি: শেরপুরে গড় জারিপার দুর্গ, দরবেশ জারিপ শাহের সমাধি এবং কসবায় মুঘল মসজিদ সহ অনেকগুলি ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক স্থান রয়েছে।
  • সুন্দর প্রাকৃতিক দৃশ্য: শেরপুর বাংলাদেশের একটি সুন্দর অংশে অবস্থিত, যেখানে ঘূর্ণায়মান পাহাড়, লঘু বন এবং স্বচ্ছ নদী।
  • সুস্বাদু খাবার: শেরপুর বিখ্যাত শেরপুর পাবদা মাছসহ সুস্বাদু খাবারের জন্য পরিচিত।
  • বন্ধুত্বপূর্ণ মানুষ: শেরপুর বাংলাদেশের সবচেয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ কিছু মানুষের আবাসস্থল।
আরও জেসব কারনে শেরপুর জেলা বিখ্যাত সেগুলির মধ্যে কয়েকটি এখানে রয়েছে:
  • গোজনী প্রকাশ কেন্দ্র: শেরপুরে অবস্থিত একটি জাদুঘর হল গোজনী প্রকাশ কেন্দ্র যেখানে এই অঞ্চলের ইতিহাসের নিদর্শনগুলির একটি সংগ্রহ রয়েছে।
  • মধুটিলা ইকোপার্ক: মধুটিলা ইকোপার্ক শেরপুরে অবস্থিত একটি প্রাকৃতিক উদ্যান যেখানে বিভিন্ন ধরনের গাছপালা এবং প্রাণী রয়েছে।
  • ঘাগড়া লস্কর বাড়ি মসজিদ: ঘাগড়া লস্কর বাড়ি মসজিদ শেরপুরে অবস্থিত একটি মসজিদ যা ১৮০৮ সালে নির্মিত হয়েছিল।
  • বড়দুয়ারী মসজিদ: বড়দুয়ারী মসজিদ শেরপুরে অবস্থিত একটি মসজিদ যা ষোড়শ শতকে নির্মিত হয়েছিল।
  • গড় জরিপার দুর্গ: গড় জরিপার দুর্গ হল শেরপুরে অবস্থিত একটি দুর্গ যেটি পঞ্চদশ শতকে নির্মিত হয়েছিল।
  • দরবেশ জারিপ শাহের সমাধি: দরবেশ জারিপ শাহের সমাধি হল ষোড়শ শতাব্দীতে বসবাসকারী সুফি সাধকের সমাধি।
  • শাহ কামালের সমাধি: শাহ কামালের সমাধি হল সপ্তাদশ শতকে বসবাসকারী একজন সুফি সাধকের সমাধি।
  • শের আলী গাজীর সমাধি: শের আলী গাজীর সমাধি হল সপ্তাদশ শতকে মুঘল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা একজন মুসলিম যোদ্ধার সমাধি।
  • কসবায় মুঘল মসজিদ: কসবায় মুঘল মসজিদ শেরপুরে অবস্থিত একটি মসজিদ যা সপ্তাদশ শতকে নির্মিত হয়েছিল।
  • মাইসাহেবা মসজিদ: মাইসাহেবা মসজিদ শেরপুরে অবস্থিত একটি মসজিদ যা অষ্টাদশ শতকে নির্মিত হয়েছিল।
  • নয় আনি, আড়াই আনি এবং পৌনে তিন আনি জমিদারদের বাসস্থান: নয় আনি, আড়াই আনি এবং পৌনে তিন আনি জমিদারদের বাসস্থান হল শেরপুরে অবস্থিত ঐতিহাসিক প্রাসাদের একটি গ্রুপ।
আপনি যদি ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ এমন কোনো স্থানের সন্ধান করেন, তাহলে শেরপুর জেলা একটি দুর্দান্ত বিকল্প হতে পারে আপনার জন্য।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন